বাংলার বিখ্যাত গণিতবিদ আতাউল হাকিমকে আমরা কতটা মনে রেখেছি

Photo of author

By Nahid

শেয়ার করুন

আরব গণিতবিদদের নিয়ে গবেষণা করেন আতাউল হাকিম।
আরব গণিতবিদদের নিয়ে গবেষণা করেন আতাউল হাকিম।

পাখি ডাকা, ছায়া ঘেরা চিরসবুজের হাতছানি দেওয়া গ্রাম নাখাইন গ্রাম। খাইন শব্দটি এসেছে বসতি বা ছোট জলাশয় খইয়া থেকে। পটিয়া কাগজিপাড়া হয়ে আরাকান রোড থেকে সোজা উত্তর পাশে যে সরু সড়কটি চলে গেছে, তা দিয়েও যাওয়া যায়, আবার গৈড়লা মোড় দিয়ে যে রাস্তাটি পূর্ব দিকে গেছে, তা দিয়েও যাওয়া যায়।

নাখাইন গ্রামে প্রবেশ করলে দেখা যাবে রাস্তার পাশে সবুজ ধানখেত, সারি সারি তালগাছ, পুকুর, বিলঝিল, ছোট সরু খাল, দৃষ্টিনন্দন নাইখাইন সন্তোষালয় বৌদ্ধবিহার। নাইখাইন গ্রামে প্রবেশ করলে দেখা যাবে নাইখাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম গণিতবিদ হিসেবে খ্যাত ডক্টর আতাউল হাকিম। পটিয়া নাইখাইন গ্রামের কৃতি সন্তান তিনি।

তিনি সেই গণিতবিদ, যার আলোর ছোঁয়াতে আলোকিত হয়েছিল ভারতবর্ষও। তিনি ছিলেন কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। অনেকটা বিস্মৃত অধ্যায়, বর্তমান প্রজন্মের হয়তো অনেকে জানেন না, বিস্মৃত অধ্যায়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিমাত্র।

জন্মকথা ও পরিবার: প্রফেসর ডক্টর আতাউল হাকিম পটিয়া নাইখাইন গ্রামের মোজাহেরুল্লাহ মুন্সী বাড়িতে ১ জানুয়ারি ১৮৯৪ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুনসী চাঁদ মিয়া। মাতা মেহের নিগার, স্ত্রী খুরশীদ আরা বেগম।

শিক্ষা : নাইখাইন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক গৌড়চ ভিক্ষুর কাছে পড়ালেখার হাতেখড়ি। নিজভূমের বর্তমান নাইখাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ছোটবেলা থেকে ছিলেন তুখোড় মেধাবী ছাত্র। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সে সময়ে তিনি বৃত্তি পেয়েছিলেন। আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানেও তিনি মধ্য ইংরেজি বৃত্তি পান, পরে তিনি সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি অধ্যয়ন করেন পটিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে। ম্যাট্রিকুলেশন চট্টগ্রাম ওল্ড স্কিম মাদ্রাসা থেকে।

চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯১৬ সালে বিএ এবং পরে এমএ অংকশাস্ত্র (প্রথম শ্রেণিতে প্রথম), ১৯১৮ সালে এমএ আরবি (প্রথম শ্রেণিতে প্রথম)। আরবি এবং গণিতে মেধার স্বাক্ষর রেখে ডবল এমএ করেন। শিক্ষাজীবনে এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ডক্টর শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি, ডক্টর টি আহমেদ, ডক্টর বি করিমসহ আরও অনেকে তাঁর সহপাঠী ছিলেন।

কর্মজীবন ও গবেষণা: আতাউল হাকিম ছিলেন আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর ছাত্র। সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আরবিতে এমএ পাস করেন। কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে। চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে বেশ কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। সে সময় তিনি ভারতের সিভিল সার্ভিসের জন্য নির্বাচিত হন। কোনো কারণে সে সময়ের সোনারহরিণ এই চাকুরিতে যোগ দেওয়া হয়নি। পরে তিনি শিক্ষাবিভাগে চাকরি নিয়ে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। সেই কলেজের অধ্যক্ষও হন তিনি।

পরবর্তীতে তিনি ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে গণিতের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। আতাউল হাকিম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর সদস্য নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি দেশে ফিরে ১৯৬০ সালের দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। সেকেন্ডারি শিক্ষা বোর্ডের কলেজের ইন্সপেক্টর ছিলেন।

আতাউল হাকিম ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। গণিতশাস্ত্রের উন্নয়নে আরব বিশ্বের তিন হাজারেরও বেশি গণিতবিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে তাঁর গবেষণার থিসিস ছিল দেখার মতো, যা এক ঐতিহাসিক গবেষণার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও বটে। তাঁর দীর্ঘ ২২ বছরের কঠোর শ্রম ও মেধার ফসল ৩৭০৬ পৃষ্ঠার ৪ খণ্ডে বিভক্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভটি সামগ্রিক জীবনের শ্রেষ্ঠতম ফসল। এটার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টর ডিগ্রি প্রদান করে।

আতাউল হাকিম ছিলেন প্রথম মুসলিম, যিনি প্রথম গণিত শাস্ত্রে ডক্টরেট সম্মানে ভূষিত হন। শুধু গণিত শাস্ত্রে নয়, একাধারে আরবিতে এবং হোমিওপ্যাথিক বিষয়ে তিনি অধ্যায়ন করেছেন। হোমিওপ্যাথি বিষয়ে তিনি পূর্বপাকিস্তানে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তিনি মেটারিয়া মেডিকেল ওপর ৪৫০ পৃষ্ঠার একটি বইও রচনা করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করে মানবসেবা শুরু করেন। এ জন্য সে সময় এলাকায় তাঁর বেশ সুনাম ছিল। পটিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর সহযোগিতা ছিল। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ইংরেজ ব্যক্তি বেকারের নামে একটি ছাত্রাবাস ছিল, সেই ছাত্রাবাসের প্রভোস্টও ছিলেন তিনি। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেকার হোস্টেলের বর্ডার ছিলেন। চট্টগ্রামের এ কে খান ছিলেন আতাউল হাকিমের ছাত্র। বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর।

দৌহিত্রদের স্মৃতিচারণা: আতাউল হাকিম সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাঁর দৌহিত্র চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সাবেক প্রধান নাজমুল লাতিফ সুহাইন বলেন, ‘দাদাজি খুব চমৎকার ও ভালো একজন মানুষ ছিলেন, দেখতে যেমন ছিলেন লাল টুকটুকে সুদর্শন, তেমনি মেধাবী। শুধু গণিতবিদ বললে ভুল হবে। একজন মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। সমাজের নানা মানুষকে আর্থিক সহযোগিতা করতেন। ছোটবেলা মা বলতেন, দাদার কাছ থেকে গণিত করা শিখতে। দাদাজি খুব সহজভাবে আমাদের অঙ্ক শেখাতেন। বাড়ি এলে নাতিদের ও আত্মীয়স্বজনদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করাতেন।’

আতাউল হাকিমের আরেক নাতি আশফাক হাকিম বলেন, ‘দাদাভাইয়ের স্মৃতি যেটুকু খুব মনে পড়ে, দাদার ওপেল কোম্পানির কমলা রঙের একটা কার ছিল, একদিন দাদাভাই ও আজিজুল হাকিম চাচার সঙ্গে গাড়ি করে ধানমন্ডি ১৫ নম্বর রোডে কোনো একটা বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাদাজিকে খুব সম্মান করলেন, তিনি দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন, পরে জানলাম, দাদা যে সময় কলকতা ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন সে সময় বঙ্গবন্ধু সেই কলেজের ছাত্র ছিলেন। দাদাজি যে সময় ইন্তেকাল করেন, তাঁর মরদেহ যখন চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সে সময় বঙ্গবন্ধু দাদাকে চিরবিদায় দেওয়ার জন্য ফুলবাড়িয়া স্টেশনের এসেছিলেন। সেই স্মৃতিটুকু আজও মনে পড়ে।’

দক্ষ সংগঠক ও অর্জন: আতাউল হাকিম শুধু গণিতবিদ ছিলেন না, একজন সংগঠকও ছিলেন। কলকাতায় সে সময় চট্টগ্রামের ছাত্রদের পড়ালেখা ও খাদ্যসংকট, চট্টগ্রামের মানুষদের চাকরি বিভিন্ন সমস্য নিরসনের লক্ষ্যে খান বাহাদুর মুহাম্মদ ইব্রাহিম, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আবদুল ওহাব চৌধুরী, নজির আহমদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট নুরুল হক চৌধুরী, মৌলানা আবদুল হামিদ প্রমুখ ব্যক্তিরা মিলে ১৯১২ সালে কলকতায় বসবাসরত চাটগাঁইয়াদের নিয়ে কলকতা চট্টগ্রাম মুসলিম ছাত্র সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। চট্টগ্রাম সমিতি-কলকাতা ১৯২৬-৩৫ সাল পর্যন্ত ডক্টর আতাউল হাকিম সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকা ৩২ তোপখানা রোডে চট্টগ্রাম সমিতির কর্মকাণ্ড শুরু করেন। যার ফসল ঢাকার বুকে একখণ্ড চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম সমিতি ভবন। আতাউল হাকিমের ঢাকার ২৮/১ তোপখানা রোডে নিজস্ব বাসভবন ছিল, চট্টগ্রাম সমিতি ভবনসংলগ্ন, যেখানে তিনি সপরিবার বসবাস করতেন। পরবর্তীতে তা বিক্রি করে দেওয়া হয়।

শেষ ঠিকানা: আতাউল হাকিমের ছিল বর্ণাঢ্য জীবন। এই সদালপি সহজ–সরল জ্ঞানতাপস মানুষটা ১৯৬৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান। তিনি ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রাম গরিবউল্লাহশাহ মাজারসংলগ্ন কবরস্থানে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মৃত্যুর ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও পটিয়ায় কিংবা চট্টগ্রামে তাঁর নিজভূমে নেই তাঁর কোনো স্মৃতি। দেশবরেণ্য, উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম গণিতবিদের নামে চট্টগ্রামে একটি গণিত একাডেমি বা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণ করা যেতে পারে।

সুত্রঃ প্রথম আলো


শেয়ার করুন

Leave a Comment