শেখ হাসিনা সহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ

Photo of author

By Nahid

শেয়ার করুন

অপরাধের ধরনের ভাষ্য
নিহত ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজের বাবা–মা আজ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে অভিযোগটি দাখিল করেন

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজকে গুলি করে হত্যার ঘটনা নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে আজ মঙ্গলবার অভিযোগটি দাখিল করেন নিহত ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভূইয়া। এটি ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে দাখিল করা প্রথম অভিযোগ। এ সময় নিহতের মা ও বোন উপস্থিত ছিলেন। এ নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ১১টি ও চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে একটিসহ ১২টি অভিযোগ করা হয়েছে।

চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে করা আবেদনে অভিযোগটি কমপ্লেইন্ট রেজিস্টারভুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের বিধান অনুযায়ী আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। ঘটনার তারিখ ও সময় ১৮ জুলাই সকাল থেকে সন্ধ্যা সাতটা এবং ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকা ঘটনাস্থল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আবেদনে।

অপরাধের ধরনের ভাষ্য, আসামিদের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে অন্যান্য আসামিরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে সাধারণ নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা, নির্যাতন, আটক, গুম করার অংশ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ফারহান ফাইয়াজকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করার অভিযোগ।

অভিযোগে বলা হয়, গত ১৮ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকার রাপা প্লাজার সামনে মূল সড়কে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। সেখানে ধানমন্ডি এলাকার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ফারহান ফাইয়াজ ও তার সহপাঠী/বন্ধু অংশ নেয়। সকাল থেকেই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়। সেই সংঘর্ষে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এইচএসসি ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ আনুমানিক দুপুর দুইটায়/আড়াটায় গুলিবিদ্ধ হয়। ফারহানের বন্ধুরা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে লালমাটিয়ায় অবস্থিত সিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

আবেদনে আসামি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মোহাম্মদপুর জোনের তৎকালীন ডিসি এইচ এম আজিমুল হক, মোহাম্মদপুর জোনের এডিসি মো. রওশানুল হক সৈকত, মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তোফাজ্জল হোসেন, রায়ের বাজার পুলিশ ফাড়ির এসআই মো. শাহরিয়া আলম, মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভূইয়া, ধানমন্ডি থানার ওসি, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক, জহির উদ্দিন আহমেদ ওরফে বিচ্ছু জালালসহ ৫৪ জনের নামসহ কতিপয় অজ্ঞাতনামা আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মী উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়, ২৩ থেকে ৫৪ ক্রমিক নম্বরের আসামিরা ১৮ জুলাই দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সরাসরি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন এবং গুলিবর্ষণ করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ফারহান ফাইয়াজ সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগ ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিয়োগের কথা জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিয়োগ পাওয়া চার আইনজীবী হলেন মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ ও আবদুল্লাহ আল নোমান। তাজুল ইসলাম এক সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের আইনজীবী ছিলেন।

ডেস্ক ওপেন করছি: চিফ প্রসিকিউটর

অভিযোগ আসার বিষয়টি আজ দুপুরে সাংবাদিককের জানান ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ সময় প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম ও বি এম সুলতান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।

ট্রাইব্যুনাল ভবনের সামনে তাজুল ইসলাম বলেন, দায়িত্ব পালনের তৃতীয় দিন। প্রসিকিউশন টিমের কাছে আজকে প্রথম ভুক্তভোগী পরিবার অভিযোগ নিয়ে এসেছেন।…গত ১৮ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলন তখন চলছিল। ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল। সেদিন রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফারহান ফাইয়াজকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। তাকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়, গানশটে তার মৃত্যু হয় বলে তার ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা আছে।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘যারাই এমন ভুক্তভোগী পরিবার আছেন, তাদের তথ্যগুলো আমরা গ্রহণ করবো। আমরা একটি ডেস্ক ওপেন করছি আজ থেকে। এই প্রসিকিউশন টিমের কাছে, এই ডেস্কের কাছে আপনারা আপনাদের ব্যক্তিগত যেসব ঘটনাবলী, যা ঘটেছে আপনাদের ওপরে আমাদের কাছে এসে জানাতে পারেন। সবকিছুকে কম্পাইল করে মামলার উপযোগী করে ট্রাইব্যুনাল যেদিন বসবেন, তখন তা বিচারের জন্য উপস্থাপন করবো।’ তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যার যে ঘটনা আছে, এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার, সেগুলো প্রসিকিউশন টিমের কাছে জমা দিতে পারবেন। সেগুলোর বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এক সময় ট্রাইব্যুনালের খবর প্রচার করা সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান ফেসবুক পোস্টে তাজুল ইসলামকে চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, একটি দলের আদর্শ ধারণ করেন বলে তাঁর নিয়োগ ঠিক হয়নি। এ বিষয়টি উল্লেখ করে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ প্রশ্নের আমি কোনো জবাব দিতে চাই না, সরকারকে জিজ্ঞাসা করেন। আইনজীবী একজন থাকে বাদীপক্ষে, আরেকজন থাকে বিবাদীপক্ষে। আইনজীবীর কাজ হচ্ছে ক্লায়েন্টের প্রতি সুবিচার করা। আমি আমার দায়িত্ব আইন অনুযায়ী, এই প্রসিকিউশনের দায়িত্ব পালন করতে পারছি কি না এবং যে অভিযোগ, ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ যথাযথভাবে ও আইনসম্মত উপায়ে ট্রাইব্যুনালের কাছে উপস্থাপন করতে পারছি কি না, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছি কি না—সেটিই এখানে বিবেচ্য হওয়া উচিত। বাকি বিষয় নিয়ে বাইরে কে কী বলছে, এটা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

সুত্রঃ প্রথম আলো


শেয়ার করুন

Leave a Comment